Thursday, April 30, 2015

ধর্ম, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে এক ঐশ্বর্য্যের নিদর্শন 'টুপি'

ধর্ম, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে এক ঐশ্বর্য্যের নিদর্শন 'টুপি'
নজিবউল্লাহ সাজওয়াল


ক্যাপ বা হ্যাট যা বাংলায় টুপি, আর টুপি হলো মাথা আচ্ছাদন করার জিনিস। আনুষ্ঠানিক বা ধর্মীয় কারণে, ফ্যাশন আনুষঙ্গিক হিসেবে, সামরিক, জাতীয়তা বোঝাবার জন্য সাধারণত টুপির ব্যাবহার হয়ে থাকে। নিরাপত্তার জন্য আমরা যে হেলমেট ব্যবহার করে থকি সেটাও এক ধরনের টুপি। টুপি নিয়ে এই কথাগুলো আমরা সবাই জানি। প্রয়োজন কিংবা ফ্যাশন যাই বলিনা কেন টুপির কদর সব সময়েই সমান গোটা দুনিয়া জুড়ে। স্টাইল আইকন থেকে শুরু করে গ্রামের সাধারণ কৃষকের মাথায়ও ঠাঁই করে নিয়েছে এ বস্তুটি। এক দিকে রোদ বৃষ্টি থেকে সুরক্ষা পেতে, অন্যদিকে চেহারায় বিভিন্ন মাত্রা সংযোজন করতেই মুলত: আধুনিক নারী পুরুষ মাথায় জড়াচ্ছেন টুপি বা ক্যাপ। ইতিহাস ঘাটা ঘাটি করলে দেখা যায় যে আদিম কাল থেকেই মানুষ গাছের পাতা দিয়ে টুপি বানিয়ে রোদ, বৃষ্টি থেকে নিজেদের মাথা রক্ষা করবার চেষ্টা করত। কেউ কেউ পশু পাখির চামড়া, পালক দিয়ে টুপি বানিয়ে গোত্রের ভিতরে তার অবস্থান প্রকাশ করত।   আজ থেকে ৬০০ বছর আগের প্রাচীন গ্রীসে ভ্রমণকারীরা সম্পূর্ণ দড়ি দিয়ে নির্মিত ক্যাপ ব্যবহার করতেন। তবে তখন ক্যাপের পেছনে কেবল মুন্ডু রৰার বিষয়টি গুরত্ব পেত। ভুলক্রমেও স্টাইলের হাতছানি ছিলনা টুপি ব্যবহারের নেপথ্যে। কালের পরিক্রমায় টুপি কেবল ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হিসেবেই বিবেচিত হয়নি বরং নানাভাবে বিভক্ত হয়ে বর্ধিত করেছে এর ব্যবহারকে। ফর্মাল, স্পোর্ট, ক্যাজুয়েল ক্যাপের বাইরেও আর দশজনের চেয়ে নিজেকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করতে আমাদের যুগে যুগে শরনাপন্ন হতে হয়েছে টুপিরই। সাহিত্যিক রাজনীতিবিদ কিংবা ফিল্ম স্টার সবাই নিজেদের স্টাইল নির্ধারণের জন্য বার বার হাত বাড়িয়েছেন টুপির দিকেই। এই টুপি'র বিভিন্ন ধরণের নাম ও প্রকারভেদ রয়েছে। সেই প্রকারভেদের মধ্যে অল্প কিছু নাম ও ছবি নিয়ে এই পোস্ট। গান্ধী টুপি- “গান্ধী টুপির” ইতিহাস ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত. তখন এই রকমের টুপি পরিহিত অবস্থায় ভারতীয়রা – ব্রিটিশ জেলে রাজ বন্দী হিসাবে থাকতেন। 


মাথায় এই সাদা টুপি পরে থাকার মানে হত যে, এই মানুষটি ব্রিটিশ শাসকদের স্বৈরাচার থেকে নিগৃহিত হয়েছেন। এই ঐতিহ্যের শুরু হয়েছে মহাত্মা গান্ধী থেকে. আরও বেশী করে এই টুপি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তা পরে থাকার পর থেকেই। তিনি এই টুপি ইংরেজ জেল থেকে বের হওয়ার পরেও বহু বছর ত্যাগ করেন নি। সাম্প্রতিককালে আন্না হাজারে ও কেজরিওয়ালের ব্যবহারের ফলে এ টুপি হয়ে উঠেছে 'দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক'। জিন্নাহ টুপি- দ্বিজাতিতত্ত্বের জনক কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ টুপি ও সু পরতেন। 

পূর্বপাকিস্তানের অনেক নেতাও পরতেন। বঙ্গবন্ধু চীন সফরের সময় শেরওয়ানি ও জিন্নাহ টুপি পরেছিলেন। এসব ছিল সেই জামানার একটা কালচার বা সংস্কৃতি। ভাসানী টুপি- মজলুম জননেতা ছিলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি লুঙ্গি পরতেন এবং মাথায় তাল পাতার টুপি দিতেন। 


মওলানা সাহেব সত্যিই গণমানুষের নেতা ছিলেন। মওলানা সাহেবই এদেশে সর্বপ্রথম ইসলামি সমাজতন্ত্রের ডাক দিয়েছিলেন। মওলানা সাহেবকে পশ্চিমা মিডিয়া বলত ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ আর ‘মাও অব ইস্ট ইন ডিজগাইজ অব অ্যা প্রিস্ট’। কেউ কেউ ‘রেড’ মওলানাও বলতেন। সাধারণ মাওলানারা ভাসানী সাহেবকে পছন্দ করতেন না। অনেকেই প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে ছিলেন। মওলানা ভাসানীর রাজনীতির মূল উৎস ছিল আল্লাহর কিতাব আল কোরআন। পীরদের টুপি- শুধুমাত্র ভারতীয় উপমহাদেশে নয় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশেও পীরদের স্বতন্ত্র টুপি ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। 


হাজি টুপি- মুসলিমদের পঞ্চস্তম্ভ পালনের অন্যতম হচ্ছে হজ্জ্ব। আর সেখানে সাদামাটা নামাজী টুপির বাইরে স্বতন্ত্রভাবে হাজি টুপির ব্যবহার রয়েছে। শিখ পাগড়ি- ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভূত শিখ ধর্মালম্বীদের স্বতন্ত্র গোলাকৃতি কাপড় মোড়ানো কুণ্ডলী শিখ পাগড়ি নামে পরিচিত। 
'কাশ্মীরী টুপি' তথা 'মান্না দে টুপি'- ত্রি দেশ তথা ভারত-পাকিস্তান-চীন শাসিত ভূ-স্বর্গখ্যাত কাশ্মীরের ঐতিহ্যবাহী টুপিটি কাশ্মীরি টুপি সারা বিশ্বে পরিচিত। 

সাম্প্রতিককালে এটা সঙ্গীতপ্রেমীদের মাঝে 'মান্না দে টুপি' নামে পরিচিত। নেপালি টুপি- নেপালি রাজা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষদের মাঝেও শত বছরের ধর্মীয়-সাস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে নেপালি টুপি ব্যবহার করে থাকে। 

শাহী টুপি- মোঘল সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে আজ অবধি রাজা-বাদশাহ ও তাদের বংশধররা ঐতিহ্যবাহী শাহী টুপি ব্যবহার করে থাকেন। 
এছাড়াও রয়েছে- নামাজ-রোজার মতো ধর্মীয় কাজে ব্যবহারের জন্য টুপি এবং স্টাইল, খেলাধুলা, রোদে ব্যবহারের জন্য টুপি। প্রতি ক্ষেত্রেই টুপির রয়েছে রকমফের। এত টুপির মধ্যেও ক্রুশ কাঁটা বা কুর্শি কাঁটায় বোনা টুপির কদরও বেশি। রমজান মাসে পাঁচ ওয়াক্তের নামাজে মসজিদে মুসলিস্নদের সংখ্যা বেড়ে যায়। কুর্শি কাঁটার টুপি প্রায় সকল মুসলিস্নর পকেটেই দেখা যায়। বগুড়ার ধুনট ও শেরপুরের গ্রামে কয়েক বছর ধরে নীরবে-নিভৃতে এই টুপি তৈরি হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তো যাচ্ছেই, বিদেশেও পাড়ি দিয়েছে এই টুপি। প্রায় ৬ ইঞ্চি লম্বা স্টিলের একটি চিকন কাঠির মুখে সুতা পেঁচিয়ে ধরার জন্য সামান্য বাঁকানো, এরই নাম ক্রুশ কাঁটা। বাম হাতের আঙ্গুলের সঙ্গে সেলাই মেশিনের ববিনের মতো সুতা এঁটে নিয়ে হাতের কায়দায় ক্রুশ কাঁটার চিকন বাঁকানো মুখের শৈলীতে তৈরি হয় টুপিসহ হস্ত শিল্পের নানা সামগ্রী। ক্যাপ-টুপির বিভিন্ন ব্র্যান্ড অ্যাডিডাস সিকে রিবক, নাইক, পিউমা প্রভৃতি হচ্ছে ক্যাপের নামী দামী সব ব্র্যান্ড। আন্তর্জাতিক ক্যাপ বাজারে দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে এ ব্র্যান্ডগুলো। তবে বিদেশি ব্র্যান্ডের পাশাপাশি আমাদের দেশীয় টুপির বাজারও কিন্তু মন্দ নয়। যদিও টুপির ফ্যাব্রিক নিয়ে তেমন একটা পরীৰা নিরীৰা হয়নি এক যুগ ধরে। 
তবে ডিজাইন ও রঙের ৰেত্রে ভিন্নমাত্রা আনার চেষ্টা করা হয়েছে। ক্যাপের টার্গেট গ্রম্নপ যেহেতু তরম্নণ প্রজন্ম ফলে ডিজাইন ও কালার সিলেকশনে প্রাধান্য পেয়েছে তরুণদের পছন্দ। স্ট্রাইপ ক্যাপের চেয়ে এক রঙা ক্যাপের কদরই এখন পর্যন্ত বেশি। প্লাস্টিকের স্ট্র্যাপের সঙ্গে এখন অবশ্য বাহারি ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হচ্ছে। এক্সক্লুসিভ ব্র্যান্ড টুপিগুলো লাইসেন্সড আইটেম হওয়ায় এগুলোর দাম একটু বেশিই। এ ব্র্যান্ড ক্যাপগুলো কেনার সামর্থ্য খুব কম বাঙালীরই আছে। তবে চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে এসব ব্র্যান্ডের ক্যাপ তৈরি হয় খোদ ঢাকাতেই। কিন্তু এদের কোনটাই বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। বাইরের দেশগুলোতে স্পোর্টস ক্যাপের চাহিদা বেশি। ক্রিকেট, বেসবল, টেনিস, জগিং এমনকি ফিলিংয়ের জন্য জন্যও আলাদা আলাদা ক্যাপ রয়েছে। আমাদের এখানে ব্যাগি, রাউন্ড, কাউন্টি, নরমাল রেপ্লিকা ক্যাপের কদর বেশি। এগুলোর দাম পড়বে ১০০-১৫০ টাকার মধ্যে। অন্যদিকে গোলটুপি, হ্যাটের দাম ২০০-৩০০ টাকার মধ্যে। একটু স্টাইলিশ ক্যাপ চাইলে বসুন্ধরা সিটির সিঙ্থ লেভেলে ঢুঁ মারতে পারেন। ইয়ংদের জন্য এখানে রয়েছে বাহারি আর জমকালো আয়োজন। মেট্রো শপিং মল ও পস্নাজা এ আরে রয়েছে টুপির এঙ্ক্লুসিভ শপ। সোল ড্যান্স ও দর্জি বাড়িতেও পেয়ে যাবেন মনের মতো ক্যাপ। মোটামুটি কম দামে বাহারি টুপির সন্ধানে যারা আছেন তাদের নিউ মার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড, ফার্ম ভিউ মার্কেট, বঙ্গবাজার, স্টেডিয়াম, গাউসিয়া মার্কেট, মৌচাক মার্কেট, গুলিসত্মান হতে পারে নির্ভরযোগ্য স্থান। কার জন্য কেমন টুপি যাদের গায়ের রঙ উজ্জ্বল তারা একটু গাঢ় রঙের টুপি বেছে নিতে পারেন। গায়ের রঙ ডার্ক কমপেস্নঙ্নের হলে লাইট কালারই ভাল। এৰেত্রে এ্যাশ, পেস্ট, স্কাই বস্নু, সাদা প্রভৃতি রঙ বেছে নিতে পারেন।
মুখের গড়ন গোলাকৃতির হলে বাকেট হ্যাট ব্যবহার করম্নন। আর ক্যাপ পরতে চাইলে মাথায় পুরোপুরি ফিট হয় এরকম বড় ধরনের মানানসই সাইজের ক্যাপ পরতে পারেন। ওভাল শেপ ও ছোট আকৃতির মুখম-লে শর্ট ব্রিম, স্পোর্ট লুকের যে কোন ক্যাপ ভাল মানাবে। 


No comments:

Post a Comment