Tuesday, March 10, 2015

ঈদে টুপি তৈরি করে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা আয় করবে বগুড়ার নারীরা

ঈদ সামনে রেখে বগুড়া জেলায় এবার সাড়ে ৫ কোটি টাকার টুপি তৈরি করা হচ্ছে। গ্রামীণ মেয়েদের এখন টুপি তৈরি করতে ক্রুচ কাঁটা হাতে আর সুতার গুটি হাতে নিয়ে ব্যস্ত দিন কাটছে। রমজান সামনে রেখে কয়েক মাস আগে থেকেই শুরু হয় তাদের এ প্রস্তুতি। এ টুপি দেশের চাহিদা মিটিয়ে পাঠানো হবে বিদেশে। এরই মধ্যে দেশ-বিদেশ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারগুলো দখল করে নিয়েছে বগুড়ার হাতে তৈরি টুপি। যতই দিন যাচ্ছে ততই এ টুপির কদর বাড়ছে। 

বগুড়া জেলা টুপি প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি জুয়েল আকন্দ জানান, বগুড়া সদর, শাজাহানপুর, শেরপুর, ধুনট, শিবগঞ্জ ও কাহালু এবং সিরাজগঞ্জের কাজিপুর ও রায়গঞ্জ উপজেলার ৪০০ গ্রামের কমপক্ষে ৫০ হাজার বিভিন্ন বয়সের নারী কারিগর রয়েছেন। তাদের সবার হাতে এখন ক্রুচ কাঁটা। এসব এলাকায় নারীরা দু’হাতের আঙুলের সঙ্গে ক্রুচ কাঁটা আর সুতা দিয়ে নানা ধরনের টুপি বুনছেন। প্রতিদিন এসব এলাকায় কমপক্ষে দেড় লাখ টুপি তৈরি করেন তারা। এ মাসে তাদের টার্গেট ৪৫ লাখ টুপি বুনোবেন। তিনি আরও জানান, বগুড়া ও পার্শ্ববর্তী দু’একটি জেলার চাহিদা পূরণের পর প্রায় ৩ কোটি টাকার টুপি রাজধানী ঢাকায় বিক্রি করা হবে। 

অন্য এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, এসব গ্রামীণ নারী ছাড়াও জেলার ২০টি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) রয়েছে যাদের প্রায় দুই হাজার নারী কারিগর প্রতিদিন ৬ হাজার টুপি বুনেন। পাশাপাশি তারা নানা ধরনের হস্তশিল্প সামগ্রীও তৈরি করেন। তাদের একটি পরিকল্পনা রয়েছে এ মাসে তারা রাজধানী ঢাকাসহ দেশে ও বিদেশের জন্য প্রায় দুই লাখ টুপি তৈরি করবেন। সূত্রটি আরও জানায়, কমপক্ষে ১০০ জন খুচরা ক্রেতা রয়েছেন যারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে গ্রামীণ নারীদের সুনিপুণ হাতে সুতা দিয়ে বুনোনো নানা ধরনের টুপিগুলো কেনেন। বহু খুচরা ক্রেতার অর্থের অভাবে নারীদের বুনোনো টুপিগুলো কিনতে হিমশিম খেতে হয়। 

বগুড়া সদর উপজেলার নামুজা ইউনিয়নের বামনপাড়া গ্রামের কোরবান আলীর স্ত্রী হেলেনা বেগম, সামছুলের স্ত্রী লাভলী বেগম, আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী শিউলী বেগম জানান, মাত্র ২০ বছর আগে ৯০-এর দশকে তারা ক্রুচ কাঁটা আর সুতা দিয়ে টুপি বুনোনো শুরু করেন। তারা বলেন, জেলার শেরপুর উপজেলার সুঘাট ইউনিয়নের চকধলি গ্রামের আজাহারের স্ত্রী ফরিদা বেগম, নুর আলীর কলেজপড়ুয়া মেয়ে নুরজাহান খাতুন ধুনট উপজেলার বিম্বহরিগাছা গ্রামের সফুরা বেগম, শান্তনা খাতুনসহ অনেকের কাছ থেকে কাজ শিখে এসে টুপির কাজ শুরু করেন। তাদের দেখে এলাকার বিভিন্ন বয়সের বহু নারী টুপি বুনোনোর কাজে ঝুঁকে পড়েন। এভাবে জেলার বিভিন্ন এলাকায় গ্রামীণ নারীদের মাঝে এ কাজ করার প্রবণতা বেড়ে যায়। বগুড়া সদর উপজেলার বামনপাড়া, শেরপুর উপজেলার বিম্বহরিগাছা, বাটকাবাড়ি, বুদ্ধগাঁথি, বাটিকাপাড়া, মথুরাপাড়া, চকধলি, জয়লা-জুয়ান, জয়লা-আলাদি, কল্যাণী, চককলোনি, গোয়াগাছি, ধুনট উপজেলার বোয়ালগাছা, বথুয়াবাড়ি, চৌকিবাড়ি, ফড়িংহাটা, কুরহাটা, বিশ্বহরিগাছা, রুদ্রবাড়িয়া, চান্দার, ভুবনগাঁথি, পাঁচথুপি, পেচিবাড়ি, চালাপাড়া, থেওকান্দী, চিথুলিয়া, মরিচতলা, মানিকপটল এলাকায় গেলেই দেখা যায় টুপি বুনোনোর কারিগরদের। 

ব্যবসায়ীরা জানান, বগুড়া শহরের বড় মসজিদ এলাকায় এসব টুপি পাইকারি কেনা হয়। গ্রামে গ্রামে গিয়ে খুচরা ক্রেতারা এসব টুপি কিনে শহরের এ দোকানগুলোতে বিক্রি করেন। পরে এসব টুপি শহরের ক্রেতারা রাজধানী ঢাকায় পাঠান। পরে ঢাকার পাইকারি ক্রেতারা এদেশ থেকে পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশগুলোতে রফতানি করেন। 
বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার কুলসুম বেগম, সফুরা বিবি, রহিমা বিবি, শান্তনা খাতুন, ফরিদা ইয়াসমিন, নারগিছ আকতার, দুলালী বেগমসহ বহু নারী টুপি নির্মাতা জানান, টুপি বুনোনোর কাজ তাদের সবাইকে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা স্বাবলম্বী করেছে। অবসর সময়গুলো নষ্ট না করে তারা টুপি বুনোনোর কাজে ব্যয় করেন। ধুনট ডিগ্রি কলেজে অধ্যয়নরত জোবেদা খাতুন, মরিয়ম বেগম, শিল্পী, চায়না খাতুন জানান, লেখাপড়ার পাশাপাশি তারা টুপি বুনোনোর কাজ করেন। এতে যে অর্থ উপার্জন হয় তা দিয়ে তারা কাপড়-চোপড়, কসমেটিক্স, বই, খাতা-কলম ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারেন। এজন্য বাবা ও মায়ের ওপর নির্ভর করতে হয় না বলে তারা জানান। মহাস্থান হাইস্কুল ও মাদরাসাপড়ুয়া মহাস্থানগড় গ্রামের সাবিনা ইয়াসমিন, সুলতানা খাতুন, আকলিমা খাতুন, নুও বানু, সালেহা খাতুন জানায়, পড়া লেখার পাশাপাশি তারা টুপি বুনোনোর কাজ করে। এতে তাদের লেখাপাড়ার তো ক্ষতি হয়ই না বরং লেখাপড়া করতে গিয়ে বিভিন্ন উপকরণ কেনার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ কাজ বহু গরিব শ্রেণীর নারী শিক্ষার্থীদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। অনেক খুচরা ক্রেতারা গ্রামীণ মেয়েদের বিনা খরচায় সুতা সরবরাহ করে। ওই সুতা দিয়ে টুপি তৈরি করা হলে সুতার দাম বাদ দিয়ে অবশিষ্ট টাকায় তারা টুপি কিনেন। মহাস্থানগড় গ্রামের টুপি প্রস্তুতকারক মুঞ্জুয়ারা বেগম জানান, এক গুটি সুতা দিয়ে (বোম) ১২টি পর্যন্ত টুপি তৈরি করা যায়। এক গুটি সুতার দাম ৬০ টাকা। ৮০ থেকে ১০০ টাকায় ১২টি টুপি বিক্রি করতে পারেন তারা। এতে টুপি প্রস্তুতকারক নারীদের এক গুটি সুতার তৈরি টুপি বিক্রি করে ২৫ থেকে ৩০ টাকা লাভ করা যায়। ১২টি টুপি তৈরি করতে তাদের কমপক্ষে তিনদিন সময় লাগে। 
আবুল কালাম আজাদ নামের এক খুচরা ক্রেতা জানান, ১২টি টুপি সে ২৪০ থেকে ২৫০ টাকায় কেনে। ১২টি টুপি তৈরি করতে তিন গুটি সুতা লাগে। তিন গুটি সুতার দাম ১৮০ থেকে ২০০ টাকা বাদ দিলে দেখা যায় ৬০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। এ খুচরা ক্রেতা জানান, তিনি সুতা আগেই দিয়ে আসেন। ৩ দিন অথবা ৬ দিন পর ওই গ্রামে গিয়ে সুতার টাকা বাদ দিয়ে লাভের টাকা দিয়ে টুপি কিনে আনেন। পরে সেগুলো শহরের পাইকারি বিক্রেতাদের নিকট বিক্রি করেন। পরে সেগুলো রাজধানী ঢাকার বায়তুল মোকাররম মার্কেট ও চকবাজার মার্কেটে বিক্রি করেন। 
রেজাউল করিম নামের এক খুচরা ক্রেতা জানান, তিনি বগুড়ার শাজাহানপুর ও সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে টুপি কিনে পাইকারি বাজারে বিক্রি করেন। একইভাবে আলী রেজা নামের আরেক ক্রেতা জানান, প্রতিটি টুপি ১৮-২০ টাকায় কিনে সেগুলো ২৫-৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়।


রোববার ৫ আগস্ট ২০১২

Related All Links:


নামাজের টুপি তৈরি ব্যবসা



কাপড়ের টুপি তৈরী: প্রস্তুতপ্রণালী, বাজারজাতকরণ, প্রশিক্ষন প্রদানকারী সংস্থা ও কেস স্টাডি





No comments:

Post a Comment