কুড়িগ্রামের টুপি যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে : বছরে ৬ কোটি টাকার বাণিজ্য
হুমায়ুন কবির সূর্য্য, কুড়িগ্রাম,২৫ জুলাই, জে নিউজ :::
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার প্রত্যন্ত পাতিলাপুর গ্রামের মানুষ এখন কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত। পাশাপাশি ১০ গ্রামে চলছে টুপি তৈরীর কাজ। আর এ কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে গ্রামের গৃহবধূ থেকে কলেজ-স্কুল পড়ুয়া ছাত্রী, অশিক্ষিত,স্বল্প শিক্ষিত বেকার কিশোরী-তরুণীরা। এই টুপি রফতানী হচ্ছে ওমান, কুয়েত, সৌদিআরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে। বছরে গড়ে ৬০ হাজার টুপি তৈরী হয় এখানে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিটি টুপির মুল্য গড়ে ১ হাজার টাকা। সেই হিসেবে বছরে প্রায় ৬ কোটি টাকার টুপি তৈরী হয় এসব গ্রামে। সারা বছরই এই টুপি তৈরীর কাজ চললেও এখন ঈদকে ঘিরে টুপি তৈরীতে ব্যস্ত নারীদের হাত। এভাবেই অনেকেই ভাগ্য বদল করেছেন মঙ্গাপীড়িত এই জনপদে। আর এই স্বাবলম্বিতার গল্পটির স্রষ্টা মোর্শেদা নামের এক সংগ্রামী নারী। টাওয়াল ফ্যাক্টরীর ডিজাইনার হিসেবে টাঙ্গাইলে থাকার সময় হাতে কলমে টুপি তৈরীর কাজ শেখেন। এরপর ১১ বছর আগে নিজ গ্রামে ফিরে প্রশিক্ষণ দিয়ে টুপি তৈরীর কলা কৌশল ছড়িয়ে দেন সবার মাঝে। উলিপুর উপজেলার পাতিলাপুর ও সংলগ্ন আরো ৯টি গ্রামের প্রায় ৬ হাজার নারী এখন টুপি তৈরীর কাজে নিয়োজিত।
উলিপুর উপজেলার শহর থেকে ৫ কি.মি. দুরে অবস্থিত মোর্শেদার পাতিলাপুর গ্রাম। এই গ্রামে সরেজমিন দেখা গেছে, কারও হাতে সাদা আর কারো হাতে রঙ বে-রঙেয়ের কাপড়। সুঁইয়ের ফোঁড়ে ফুটে উঠছে নান্দনিকতা। বিশেষ কায়দায় সেলাই করা কাপড় বা রেশমার উপর নক্শা তৈরী করে টুপি তৈরীর করছে এলাকার বিভিন্ন বয়সী নারীরা।
এই গ্রামের মধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম নেয়া অদম্য নারী মোর্শেদা বেগমের বিয়ে হয় একই গ্রামের জোবেদ আলীর সাথে। তখন মোর্শেদা দশম শ্রেণীর ছাত্রী। বিয়ের পর স্বামীর সাথে টাঙ্গাইলের একটি টাওয়াল ফ্যাক্টরীতে কাজ করার জন্য চলে যান। সেটা ১৯৯৫ সালের কথা। সে সময় প্রতিবেশী কমলা বেগমের টুপি তৈরীর কাজ দেখে দেখে রপ্ত করেন কলা-কৌশল। প্রথম টুপি তৈরীর করে মজুরি পান ৩৫০ টাকা। ১১ বছর আগে ফিরে আসেন গ্রামে। মোর্শেদা জানান, সে সময় তার কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে বেসরকারি সংস্থার একজন কর্মকর্তা তাকে ৫০টি টুপি তৈরীর অর্ডার দেন। এতে লাভ হয় ১৭ হাজার টাকা। এরপর মোর্শেদার মনে স্বপ্ন দেখা দেয় দিনবদলের। দরিদ্রপীড়িত এই এলাকার বেকার নারীদের কাজের ব্যবস্থা করে মঙ্গা নিরসনের জন্য কাজ শুরু করেন তিনি। নিজের কাজের ফাঁকে টুপি তৈরী করে যে আয় করা যায় -এই ভাবনা ছড়িয়ে দেন গ্রামের নারীদের কাছে। শুরু করেন নিজ বাড়িতে প্রশিক্ষণ। সাফল্যের গল্প শুনে দলে দলে নারীরা আসতে থাকে তার বাড়িতে। এখন নিজ গ্রামের গন্ডি ছাড়িয়ে নাগরাকুড়া, থেতরাই, কুকুয়াপাড়া, চরুয়াপাড়া, দলদলিয়া, থেতরাই, পান্ডুল, গুনাইগাছ, বাঙালি গ্রামসহ পৌর এলাকার কয়েকটি পাড়ায় চলছে টুপি তৈরীর কাজ।
মোর্শেদা জানান, ফেনীর দু’জন ব্যবসায়ীর কাছে তিনি তৈরী করা টুপি বিক্রি করেন। আর এই টুপি মধ্যপ্রাচ্যে বিক্রি হয়। ওই ব্যবসায়ীরা তার কাছে রেশমা সরবারহ করেন। এরপর তিনি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের সঙ্গে নিয়ে স্রেফ সুঁই সুতা দিয়ে তৈরী করেন নানা ধরণের নক্শাখচিত টুপি। প্রতিটি টুপি তৈরীর জন্য পারিশ্রমিক পান ৩০০-৩৫০ টাকা। এতে সুই সুতার খরচ ৩০-৪০ টাকা। প্রতি টুপিতে তিনি কমিশন পান ৩০-৪০ টাকা। প্রতি গ্রামে সুপারভাইজার নিয়োগ করে কাজের তদারকির পাশাপাশি ঝড়-বৃষ্টি উপক্ষো করে পায়ে হেঁটে ও রিক্্রায় গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে তিনি টুপির তৈরীর কাজ দেখভাল করেন। এভাবে মাসে গড়ে ৫ হাজার টুপি সরবারহ করেন। তবে ধান কাটার মৌসুমে গ্রামের নারীরা ব্যস্ত থাকে বলে উৎপাদন কমে যায়। হাতে অন্য কাজ না থাকলে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে টুপি তৈরীর কাজে। মিয়াপাড়ার সীমা (২২), হোকডাঙার রোকসানা (১৯), খাদিজা (২০) জানান, তারা মোর্শেদা বেগমের কাছে ট্রেনিং নিয়ে দু’বছর ধরে টুপি তৈরীর কাজ করছেন। বেকার এই যুবতিরা নিজেদের সংসারের কাজের ফাঁকে টুপি তৈরীর করে মাসে ৬ শত থেকে ৭ শত টাকা আয় করেন। গৃহবধূরা আয় করেন দেড় থেকে দু’হাজার টাকা। থেতরাই হাইস্কুলের ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী শাপলা বলেন, ‘স্কুল থেকে এসে কিছুক্ষণ এই কাজ করি। নিজের উপার্জন দিয়ে খাতা কলম কিনি। গরীব বাবার কোন বোঝা হয়না তাতে’। উলিপুর মহিলা কলেজে ডিগ্রিতে পড়েন আফরোজা। পড়াশুনার ক্ষতি না করে ১৫-২০ দিনে একটি টুপি তৈরী করে আয় করছেন। এই এলাকার আনোয়ারা (৫০), রুপালীা (৫৫), সুরমা (৪০) বলেন, ‘মোর্শেদা আপা আমাদের নতুন জীবন দিয়েছেন। এখন শুধু স্বামীর উপার্জনের উপর নির্ভর করতে হয়না। স্বামীর সংসারে এখন অনেক সাহায্য করতে পারি। অবসরে টুপি তৈরীর কাজ করি বলে নিজের সংসারের কোন কাজের ক্ষতি হয়না’।
দরিদ্র মোর্শেদা টুপি তৈরী করে স্বাবলম্বি হয়েছেন। ৪ রুম বিশিষ্ট আধাপাকা বাড়ি করেছেন। জমি কিনেছেন ২ লাখ টাকার। দু’মেয়েকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। এখন মোর্শেদার স্বপ্ন এলাকার দরিদ্র নারীদের স্বাবলম্বি করা। এজন্য ৬-৭ লাখ টাকার পুঁিজ পেলে টুপি তৈরীর প্রধান উপাদান রেশমা তৈরীর কারখানা দিবেন। আর এটা সম্ভব হলে এই এলাকার ১৪-১৫ হাজার নারীর কাজের ব্যবস্থা তিনি করতে পারবেন।
Source: http://bangla.jnewsbd.com
No comments:
Post a Comment