জমজমাট টুপির বাজারসারাদেশের জন্য দেশ বিদেশের নানা রকম নকশা ও বুননের টুপির চাহিদার জোগান দিয়ে থাকেন চকবাজারের টুপি ব্যবসায়ীরা। তারা এখন দারুণ ব্যস্ত। রমজান মাস শুরুর দিন থেকেই সারাদেশের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সেখান থেকে টুপি কিনে নিচ্ছেনহাসান শান্তনু ঈদে নতুন জামা-জুতার সঙ্গে টুপিরও রয়েছে আলাদা চাহিদা। রাজধানীর বায়তুল মোকাররম এলাকায় দেশীয় হাতে তৈরি নকশার টুপির সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে ভারতীয়-পাকিস্তানি রং-বেরঙের টুপি _যাযাদিঢাকার চকবাজারে টুপির ব্যবসার ইতিহাস তিন কালের পুরনো। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের শাসন চলাকালে কয়েকজন বাঙালি ছিলেন টুপির কারিগর। নিজেরা টুপি বানিয়ে সেখানে বিক্রি করতেন। তখন বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে টুপি পরার রেওয়াজ চালু ছিল বেশ রকম। পাকিস্তান আমলেও চকবাজারের টুপির ব্যবসার ধরন প্রায় একই রকম থাকে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে সময় গড়ানোর সঙ্গে আরো বিস্তৃত হয় টুপির বাজার। দেশের বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হওয়া টুপি ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র হয় চকবাজার। এভাবেই চকবাজার হয়ে ওঠে টুপির পাইকারি বিক্রির দেশের অন্যতম বড় বাজার। অন্যান্য বারের মতো এবারকার ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে জমজমাট হয়ে উঠেছে সেখানকার টুপি ব্যবসা।
ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আজহা_ মুসলমানদের অনাবিল আনন্দের ধর্মীয় এই দুই উৎসব উদযাপন হয় নামাজের মধ্য দিয়ে। পাঞ্জাবি বা অন্য যে কোনো পোশাকের সঙ্গে ঈদের দিন সব বয়সী পুরুষের মাথায় ঝকঝকে ও বাহারি নকশার টুপি থাকা চাই। ধর্মীয় রীতিতেই টুপি নামাজের বিশেষ অনুষঙ্গ। আর সারাদেশের মানুষের জন্য দেশ-বিদেশের নানা রকম নকশা ও বুননের টুপির চাহিদার জোগান দিয়ে থাকেন চকবাজারের টুপি ব্যবসায়ীরা। এখন তাই দারুণ ব্যস্ত ওই টুপির বাজার। রমজান মাস শুরুর দিন থেকেই সারাদেশের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সেখান থেকে টুপি কিনে নিচ্ছেন। তারা মনে করেন, রমজানের শেষদিকে খুচরা বাজারে এসব টুপি বিক্রি হবে।
চকবাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী দৈনিক যায়যায়দিনকে জানান, এখন প্রতিদিন কত টাকার টুপির ব্যবসা হচ্ছে, এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে একজন পাইকারি বিক্রেতা প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ টাকার টুপি সরবরাহ করছেন। এই হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ টাকার টুপি চকবাজার থেকে পাইকারি ক্রেতাদের হাতে চলে যাচ্ছে। এছাড়া ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেট, কাঁটাবন মসজিদ এবং কাকরাইল মসজিদ এলাকার কয়েকজন টুপি ব্যবসায়ীও সারাদেশে পাইকারি টুপি বিক্রি করছেন। তারা প্রতিদিন গড়ে ১০ লাখ টাকার টুপি পাইকারি বিক্রি করছেন। সব মিলিয়ে রমজানে ঢাকা থেকে দিনে গড়ে ৬০ লাখ টাকার টুপি সারাদেশে যাচ্ছে বলে ব্যবসায়ীদের ধারণা। সারাদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, নিউ মার্কেট, ইস্টার্ন প্লাজা এবং রাজধানী সুপার মার্কেটসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বিপণি বিতানের দোকান মালিকরাও চকবাজার থেকে পাইকারি টুপি কিনছেন। ঈদের ৫-৬ দিন আগে পর্যন্ত পাইকারি বাজারে টুপির ব্যবসা এভাবে জমজমাট থাকবে বলে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান।
ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্যমতে, দেশে বিভিন্ন মানের টুপি পাইকারি বিক্রির বড় বাজার হচ্ছে পুরান ঢাকার চকবাজার। সারা বছর বিক্রি চললেও টুপির ব্যবসা অনেকটা মৌসুমি এবং ঈদকেন্দ্রিক। ঈদের আগেই ক্রেতার বিরাট চাহিদা থাকে টুপির প্রতি। রমজানের আগে থেকেই ব্যবসায়ীরা তাই পুরোদমে ব্যবসার প্রস্তুতি নেন। বছরের অন্যান্য সময় টুপি বিক্রি কম হলেও রমজানে যে পরিমাণ বিক্রি হয়, তাতে পুরো পুঁজি উঠে আসে। চকবাজারে টুপির পাইকারি দোকান আছে ৩২টি। এ সময় নিয়মিত দোকানগুলোর পাশাপাশি সেখানে বসে ২০-২৫টির মতো মৌসুমি দোকান। অন্যান্য বছরের মতো এবারো এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। কম সময়ে লাভ বেশি বলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা টুপি বিক্রি করতে রমজানে নেমে পড়েন। আবার ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ নিজস্ব ব্যবসা ছেড়ে রমজানে বেশি লাভের আশায় শুধু টুপির ব্যবসা শুরু করেন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, চকবাজারের টুপির বাজারে পাইকারি ক্রেতার প্রচ- ভিড়। খুচরা ক্রেতাদের উপস্থিতি নেই_ এমনটাও বলা যাবে না। খুচরা ক্রেতাদেরও নিরাশ করেন না বিক্রেতারা। দুই রকমের ক্রেতার পদচারণা আর বিক্রেতাদের হাঁকডাকের ভারে মুখরিত বাজার। প্রতিদিন সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা এবং প্রত্যন্ত এলাকার পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা টুপি কেনার জন্য সেখানে আসেন। নূরানী, আল কবির এবং আল ফারুক টুপির পাইকারি বিক্রেতা মুসলেহ উদ্দিন জানান, রমজানের শুরু থেকে সারাদেশেই খুচরা বিক্রেতাদের টুপির অর্ডার বাড়ছে।
টুপি ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফা জানান, দেশের জন্য সম্ভাবনাময় একটি খাত টুপি শিল্প। সরকার এতে নজর দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়ালে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আরো বেশি টুপি রপ্তানি সম্ভব হবে।
চকবাজারের সৌদিয়া ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী বদির উদ্দিন ইরানের মতে, আগে টুপির ব্যবসা আরো ভালো ছিল। এখন মেশিনে কাপড়ের টুপি তৈরি হওয়ায় সুতার টুপির কদর কমে গেছে। তবে যারা চেনেন, তারা হাতের টুপিকেই বেশি মূল্যায়ন করেন। হাতের টুপির বেশি ক্রেতা শৌখিন মানুষ।
তিনি জানান, চকবাজারে বিক্রি হওয়া টুপিগুলো তৈরি হয় ঢাকার জিঞ্জিরাসহ আরো কয়েকটি এলাকায়, নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ মার্কেট, নরসিংদীর বাবুরহাট এবং বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
আলিফ ক্যাপ ইন্ডাস্ট্রিজের বিক্রেতা আসাদ রহমান জানান, তাদের তৈরি টুপি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাজারজাত হয়। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও রপ্তানি হচ্ছে। অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে টুপি রপ্তানিতে আগে বিকল্প নগদ সহায়তা দেয়া হতো। বর্তমানে তা বন্ধ রয়েছে।
তিনি জানান, বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার টুপির ব্যবসা হয়। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রপ্তানি হয় প্রায় ৪০০ কোটি টাকার টুপি।
জানা গেছে, টুপি ব্যবসায়ীদের আলাদা কোনো সমিতি নেই। আগে একটা সমিতি থাকলেও তা এখন বিলুপ্ত। তবে সমিতি গঠনের উদ্যোগ আছে। ব্যবসায়ীরা এখন চকবাজার মনিহার বণিক সমিতির আওতায় আছেন।
অন্যদিকে, পাইকারি ও খুচরা বাজারে টুপির যেমন নামের ভিন্নতা আছে, তেমনি আছে দামের পার্থক্য। জালি, গোল, আড়ি, এসি, সাতে এবং চায়নাসহ বিভিন্ন ধরনের টুপি চকবাজারে পাওয়া যায়। শহিদ, আল ফারুক, লেইস, পুশিকাটা পুঁতি এবং টরে টুপিও পাওয়া যাচ্ছে। আছে সৌদি আরব, পাকিস্তান, ইরান, চীন ও ইরাকের টুপি। দেশি টুপির দাম ৩৬ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত রাখা হচ্ছে। মাঝারি মানের টুপি ৪০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। আর বিদেশি টুপির দাম পড়ছে ৩০০ থেকে ৩ হাজার টাকা।
Source: www.jjdin.com
No comments:
Post a Comment